
১৫ জুলাই ২০১৭
ক্লাস ওয়ান, টুয়ের ছাত্র হবে। দুজন কথা বলছে।
‘তুই কুইশ্যাল (আঁখ) পাগল। আর আমি হইলাম পেয়ারা পাগল, আম পাগল।’
‘আমি কুইশ্যাল পাগলও, আর তুই যেন্ন্যায় (যেসবে) পাগল, হেন্ন্যায়ও (সেসবেও) আমি পাগল।’
‘আমি আম বানর, পেয়ারা বানর।’
‘বানর?’
‘হ।’
‘আমিও বানর!’
আঁখ কামড়ে খাচ্ছে আর তাদের এমনই আলোচনা চলছে। পাশ কাটিয়ে চলে এসেছি। হাসি পাচ্ছিল। ওদের আলোচনা কিন্তু চলছিল একরকম গুরুগম্ভীরভাবে।[1] আমাকে আবার কেউ পাগলের হাসি হাসতে না দেখে, তাই ঠোঁট চেপে গাল ফুলিয়ে হাসি চাপতে চাপতে এগোলাম। কলেজ ছুটির পর যাচ্ছিলাম মামাদের মেসে।
মেসে এক মামা আরেক মামাকে, মানে মামার এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে বসল, ‘বলেন তো ইক্ষু মানে কী?’ ও-জন চুপ মেরে গেলেন। এর উত্তর কীভাবে দেবেন, বুঝতে পারছিলেন না। দেশের বাড়ি হলো গিয়ে পাবনা। ওখানকার মানুষ ইক্ষুকে কী বলে, তা বলে আবার না আমাদের হাসির পাত্র হন, সমস্যাটা মনে হলো এই-ই। তা যা-ই হোক, তিনি যে ইক্ষুটা কী তা জানেন, এটিই বোঝাতে চাইলেন এভাবে, ‘ইক্ষুতে মিষ্টি আছে না!’
আচ্ছা, থাকুক। অন্য আলোচনায় আসি।
কলেজ থেকে বের হয়ে গাড়ি চলার রাস্তার দিকে আসছিলাম। কাছে এসে পড়েছি, আমাদের আগে আগে হাঁটা দুইজন ছাত্রকে একটা ছেলে ডেকে নিল একপাশে। এই ছেলেটিও হতে পারে ছাত্র। জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাদের বাসা কই?’
পাশ কেটে আমরা দুজন চলে এলাম। আমি আর আমার এক সহপাঠী। তার নাম হৃদয়।
‘ওরা চলে যাক, তারপর যাই।’ হৃদয় আমাকে বলল। দেখলাম চার-পাঁচটি ছেলে জড়ো হয়েছে। তাদেরকে কেউ বখাটে বললে বিস্মিত হব না।
কিছুক্ষণ পর বাজারের দিকে চলতে লাগলাম। হৃদয় বলে উঠল, ‘এই কলেজ তুমি
পছন্দ করেছ?’
‘হ্যাঁ।’ আমি বললাম। কারণ কলেজের স্যার-ম্যামদেরকে আমার ভালো লেগেছে। হৃদয়কে বললাম, ‘কলেজ পছন্দ না হওয়ার তো তেমন কিছু পাইনি।’
‘পাওনি? আচ্ছা, তুমি কি বোঝ কিছু? না এমন, বুঝেও না বোঝার ভান করো?’
আশ্চর্যের প্রশ্ন! বুঝতে পারলাম না ও এভাবে কেন আমাকে প্রশ্ন করছে। একটু ভাবলাম। সেই ছাত্র দুজনকে ডেকে নিল আমাদের চেয়ে বড় একটা ছেলে। ওই ছেলেটা, আর তার পাশে থাকা তার মতোই আরও কয়েকজন, তারা তো কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী না?
এক-দুদিন আগে এ কলেজ নিয়ে একটা ধারণা দিয়েছিল আমার ছোটবেলার বন্ধু সোহেল। এবার ইন্টার পরীক্ষার্থী ছিল। তাই কলেজ সম্পর্কে আমাকে ধারণা দিতে আসা তার একটা কাজ হতে পারে। সে বলেছিল, ‘রাজনীতির উপদ্রপ আছে। ওদিকে গিয়ে ভালো ছাত্রগুলো শেষে নষ্ট হয়। বড় ভাইয়েরা আসে, ডাকে, বলে, ক্লাস করতে হবে না, চলো আমাদের সাথে। তাদের উলটো কিছু বলতে গেলেই চড়থাপ্পড় খেতে হয়। তোমার সাথে তেমন কিছু ঘটবে না অবশ্য। মাহমুদুল হাসানেও (টাঙ্গাইলের সেরা কলেজগুলোর একটি) এসব চলত। ওপেনে…।’ তার শেষ শব্দটা কি বলব! প্রবৃত্তি হচ্ছে না।…রাজনীতি করা কলেজ-ভার্সিটির ছেলেদের কারও সাথে কারও, বা কোনো দুই দলের মতের অমিলে সর্বশেষ যা ঘটে আরকি।
আরেকটু সামনে এগোতেই পেছন থেকে কানে এলো, ‘…ওদিকে যা, মেয়ে বাগা।’ সো স্যাড। এবং একটা মোটরসাইকেল আরোহী ছেলে এগোল। ঘটনা এই।
হৃদয়কে বলতে গিয়ে থেমে গেলাম, ‘আমি বুঝতে না পারলে বুঝিয়ে দেবে, ভুল হলে ধরিয়ে দেবে, শুধরে দেবে,’ বলা হলো না, চোখ পড়ল রাস্তার বামে একটু দূরে, ভার্সিটির দেয়ালঘেঁষা পথে একটা মেয়ে হাঁটছে, তাঁর পাশে কয়েকটা ছেলে।
‘ওউউহ!’
‘কী, এখন বুঝেছ?’
‘মেয়েটির সাথে ওরা কথা বলার চেষ্টা করছে।’
‘কোনো মেয়ের সাথে কথাও বলব না, ঝামেলায়ও জড়াব না।’
‘প্রয়োজনে কথা বললে আমাদের তাতে ঝামেলা কী?’
‘উহ-রে! তুমি কিছুই বোঝ না? ওই দুই ছাত্রকে ডেকে নিল কেন, জানো?’
‘কেন?’
‘ওরা কেন এই মেয়েটির সাথে কথা বলেছে!’ (এই বাক্যের ভাবানুবাদ হলো, এ মেয়েটির সাথে কথা বলার অধিকার তাদের নেই। আর বুঝলাম, নিশ্চয় ছাত্র দুজন কোনো একসময় কথা বলেছে, যা ওই বড় ছেলেটার চোখে পড়ে গেছে।)
‘বুঝেছি।’
‘সব ঝামেলা, বুঝলে, এই মেয়েদের নিয়েই।’
একা পথচলা, জানি না, মেয়েটা কীভাবে শেষ করেছে।
গত সপ্তাহ, ওই মেয়েটাই প্রথম যেদিন আসে, আমার একটু অবাক হওয়ার ঘটনাই ঘটেছিল। ক্লাসমেট, একটা ছেলে, তার নকল নামটা কী দেওয়া যায়! আচ্ছা, বকুল। আমাকে বলছিল, এখন থেকে প্রতিদিনই আসতে হবে কলেজে। মেয়েটাকে হাতছাড়া করা চলবে না। কথাটা শুনে তার কাছ থেকে দ্রুত এগিয়ে গিয়েছিলাম আমাদের আরেক ক্লাসের দিকে। এসব আমি পছন্দ করতে পারি না। ক্লাসে, মেয়েটির খাতা আনা হয়নি, বকুলের জানা হলো। বকুল আমার কাছে চাইল একটি খাতা, ব্যাগ থেকে বের করে তাকে দিলাম। বকুল হাত বাড়িয়ে ডান সারির বেঞ্চে বসা ওই মেয়েটিকে দিলো।
এরপর সেদিন ক্লাসে বকুল দুইটি কাগজের প্লেন বানিয়েছিল। একটির সাথে আরেকটির মাথা লাগিয়ে মেয়েটিকে দেখিয়ে সে কিছু বোঝাতে চেয়েছে।
মামার মেস থেকে ফেরার পথে এইসব নিয়েই ভাবছিলাম। ভাবতে ভাবতে এসে বাস যেখানে থামে সেখানে দেখতে পেলাম, বাস দাঁড়িয়ে আছে। দ্রুত গিয়ে উঠে পড়লাম। বাসে মনটা হঠাৎ খুশি হয়ে উঠল। এক ছোট্ট খুকুমণি তার আব্বুর কোলে দাঁড়িয়ে কবিতা বলছে—
‘হাত্তি নাচে ঘোড়া নাচে
খুকুমণির বিয়ে।…’
[1] আট বছর পর লেখাটি সম্পাদনা করতে গিয়ে চোখে ভাসছে সেদিনের দৃশ্য। ওদের চেহারাটা আবছা দেখছি। তবে দুজনের একজনকে ছেলে আরেকজনকে মেয়ে লাগছে। হয়তো ওরা দুই ভাইবোন ছিল।