দিনলিপি

কলেজ বনাম চাকরি

মাসউদ আহমাদ

(২০১৭ সাল, জুন)

খালা আমাকে বললেন, ‘কলেজে পড়ে কী করবি? বাংলাদেশে এখন লক্ষ লক্ষ বেকার। কলেজের সার্টিফিকেট নিয়ে তুই কীসের চাকরি করবি?’

কেউ আমাকে সার্টিফিকেট নিয়ে চাকরির কথা বললে, সেটা আমার কখনোই ভালো লাগেনি। আর যখন খুব আপনজনের মুখ থেকে এমন কথা বের হলো, আমার সেটা মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হলো। নানির বাড়ি ঘরে চৌকির ওপর খানিক আগেই খেতে বসেছি। খুব ক্ষুধা পেয়েছিল। সারাদিন রোজা ছিলাম। ইফতারের পর আর কিছু খাইনি। তারাবি পড়ে এসে বসেছি।

আমার অনেক কান্না পেল। কেঁদেই খালাকে বললাম, ‘সবাই শুধু আমাকে চাকরির কথা বলে! আমি কি চাকরি করব বলেই এত কষ্ট করে পড়ালেখা করছি!’ নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। আর কথাও বলতে পারলাম না। খেতেও পারলাম না আর। বুক ভেঙে কান্না আসতে লাগল। আর যে-কেউই আমাকে বলুক, আর যতই খুঁচিয়ে বলুক, কিন্তু খালা কেন আমাকে বলবে! চোখের পানিও আর আটকাতে পারলাম না। এত কষ্ট হলো! আমার অতি আপনজনও এত হতাশার কথা বলবে!

খাওয়া ছেড়ে চৌকি থেকে নেমে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলাম। টিউবওয়েলের কাছে গিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কান্না থামালাম। হাত ধুলাম। কুলি করলাম। তারপর বাস্তববুদ্ধির সাথে ভাবলাম যে, এখন কী করব। ঘরে তো ফিরে যেতে পারি না। এমন তো কোনোদিন হয়নি, অন্তত বুদ্ধিশুদ্ধি হওয়ার পরে তো নয়ই, আর এই কলেজে পড়ার বয়সে এসে এমন করে কান্নাকাটি করে ফেললাম। ঘরে খালার পাশেই নানি বসা আছেন। আমার খানার তদারকি করছিলেন তিনিই। তারা কেউই তো এমন প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবতে পারেননি। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম। একটু লজ্জিতও হলাম। কিন্তু তখনও খুব কষ্ট লাগছে।

এই রাত্রিবেলা গেট দিয়ে বের হয়ে গেলাম। রাস্তায় নেমে ভাবতে থাকলাম, কোথায় যাব। আর কান্না চাপতে থাকলাম।

দশ-পনেরো মিনিট হেঁটে দক্ষিণপাড়া মসজিদে পৌঁছলাম। নানা এখানে ইতেকাফে আছেন।

রাতে নানার বিছানায়ও রইলাম না। ইতেকাফকারীদের পর্দাঘেরা সীমানাটুকুর বাইরে দক্ষিণ পাশের জানালার কাছে টাইলসের ফ্লোরে শুলাম। কিন্তু ঘুম এলো না। পেটে তখনও ক্ষুধা। আর আছে মশার কামড়। বুকের ভেতরটাও কেমন লাগছে। একটু পরপর বুক ভেঙে কান্না আসছে। এই রাত, সারারাত এভাবে কেঁদেকেটে কাটালাম। সারারাত ভাবলাম, খালা কেন আমাকে ওভাবে বলতে গেল! আর ভাবলাম, এখন খালার ‘উচিত শাস্তি’ হবে। নানিও বকবেন, কেন হাবিজাবি কথা আমাকে বলেছে। আমার মতো খালাও কাঁদবেন, নিশ্চয়ই তারও ঘুম হবে না ভুল বুঝতে পেরে।

সেহরিতে নতুন রোজার নিয়ত করলাম মসজিদের ট্যাপ থেকে পানি খেয়ে। আমার নানা খুব বৃদ্ধ। একশর মতো বয়স। তাই আমি চাইনি সেহরির সময় আমার উপস্থিতি তাকে টের পাইয়ে দিতে, আর তার খানায় নিজেকে শরিক করে নিতে। কেবল মসজিদে আসার পরই তার সঙ্গে সেই দেখা করেছি।

এই মসজিদের কাছে আমার আরেক খালার বাড়ি। ফজরের নামাজের সময় মসজিদে খালু আর খালাতো ভাইয়েরা এসেছেন। আমি কিছুতেই নিজেকে তাদের সামনে প্রকাশ করতে চাইলাম না। মসজিদের এক কোনায় নামাজ পড়লাম। নামাজ শেষে খালু এসে নানার পর্দাঘেরা জায়গাটায় ঢুকে জোর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার কাছে কি মাসুদ আসছিল? জাহিদুল (আমার ছোটমামা) মোবাইল করল, মাসুদ নাকি বাড়িতে নাই।’ আমি বসে ছিলাম পর্দার অন্যপাশেই। অন্য মুসল্লিরা তো আর আমাকে চেনে না। তাই তারা আমাকে দেখতে পেলেও শান্ত থেকেছি। তখন নানা বললেন, ‘ও তো আসছিল আগ-রাতে।’

গজগজ করতে করতে খালু মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেলেন। নামাজের বেশ কিছু সময় পর, দিনের আলো ফোটার কিছুটা আগে আমিও মসজিদ থেকে বেরিয়ে এলাম। লজ্জার মাথা খেয়ে বাড়ি গেলাম। ততক্ষণে শান্ত হয়ে গেছি। তখন আর কান্না পাচ্ছে না।

বাড়িতে কেউ কিছু আমাকে বলল না। রাতে বাড়িতে পরে কী ঘটেছে, জানার কৌতূহল জেগেছিল। কিন্তু আমিও চুপচাপ রইলাম। আবার আজকেই আমার বাড়ি ফেরার কথা ছিল। খালার সাথেই করটিয়া গিয়ে ঈদের মার্কেট করলাম। তারপর আমাদের শহরে এলাম। খালা আমাকে বেশ কিছু টাকা দিলেন। পরে কলেজে ভর্তি হয়ে তা দিয়েই পাঠ্যবই কিনেছি।

ঈদের পর নানিবাড়ি যাইনি। মা গিয়েছেন। সেখান থেকে এসে মা আমার সামনে আমাকে নিয়ে অনেক আফসোস করলেন। তার মুখেই প্রথম শুনলাম, সেই রাতে মামা (ছোট মামা) আমার এ কাণ্ড জানতে পেরে সারা এলাকা খুঁজে ফিরেছে। কোথাও আমাকে পায়নি। সবাই চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। মামার কথা আমি এমন ভেবেছিলাম, সেহরির সময় বড় ঘরে খেতে এসে যখন আমাকে পাবে না, আমার কথা জিজ্ঞেস করবে, মাসুদ কোথায়, তখনই জানবে যে, আমি সারারাত ধরেই বাড়িতে নেই। কিন্তু মামা জেনেছে অনেক আগেই আর যথেষ্ট পেরেশানও হয়েছে।

আমি জানি সবাই আমাকে কত ভালোবাসে। তারা আমাকে কতটা ভালোবাসে, সে কথা আমি কোনোদিন সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারব না। আমি জানি, আমার নানি, খালা, মামার ঋণ কোনোদিনই শোধ করতে পারব না। আমার কষ্ট হয়েছে, সেজন্য তারাও কষ্ট পেয়েছে। তাদের কষ্টের কথা ভেবে আমারও বুক ভারী হয়েছে। এখনো তাই। এই যে দুচোখ অশ্রুসিক্ত হলো!

Series Navigationব্যতিক্রমী ফলাফল >>
এই রচনাটি ‘কলেজিং’ সিরিজের একটি অংশ। মোট 9 অংশে বিভক্ত এই সিরিজটি। বর্তমান অংশটির ক্রমিক হলো 1। হ্যাপি রিডিং!

Related Articles

Back to top button
error: উঁহু, কপি করতে চান নাকি!