
৪ মে ২০১৭
পরীক্ষার ফলাফল শুনে আমার যা হাসি পেল না! ওই মুহূর্তে যে-কেউ আমাকে দেখলে দিব্যি পাগল ঠাওরাত। ফলাফলটা খুব ভালো হয়েছে, ব্যাপারটা আসলে তা নয়। আমি পাশ করেছি, সেটাই যথেষ্ট। পরীক্ষার দিনগুলোয় তো সময়ের খুব সদব্যবহার করেছি। পড়েছি আর পড়েছি। কী পড়েছি তা তো বোঝাই যাচ্ছে, পরীক্ষা বলে কথা, তাই না! কিন্তু বলি কী, এই ধারণাটা না, সত্যি না। তাহলে কী। আসলে পাঠ্যবই সে তো পাঠ্যবই, আমি বেশি করে মনোযোগ দিয়ে তিন গোয়েন্দা পড়েছি।
এখন আমার খুশির সাথে আরেকটা খুব দুঃখজনক খবর হলো, ছেলেদের মধ্যে তিনজন বাদে সবাই… সবাই, মানে সবাই ফেল করে বসেছে, পাশ করা তিনজনের মধ্যে আমি একজন।
এখন একজন ম্যাডামের কথা মনে পড়ছে খুব। তার সাথে যোগাযোগ করতে ইচ্ছা করছে। তিনি আমার ওপর ‘আন্তরিকভাবে’ অসন্তুষ্ট ছিলেন। তার কথা শুনিনি আমি। একদিন পরীক্ষার হলে এসে আমার দিকে যেভাবে তাকিয়েছিলেন, মনে পড়লে এখনো অস্বস্তি হয়, আর দুঃখবোধ জাগে। এখনকার সময়ে শুনলে কেউ আশ্চর্য হবে কি না। ম্যাডাম আমাকে বলেছিলেন, পরীক্ষার যে প্রশ্ন পারব না তা যেন ‘নকল’ করে হলেও লিখি। কিন্তু—
একদিন যখন পুরো হলজুড়ে সবাই ‘ক সেট’ লিখছিল, একমাত্র আমিই এক বান্দা ‘গ সেট’ লিখছিলাম। একদিন তো একজন ‘গার্ড’ সবাইকে ‘ক সেট’-এর উত্তর বলে দেওয়ার সময়—ঘটনাক্রমে আমার প্রশ্নটিও ‘ক সেট’ থাকায়—আমি কানে হাত চেপে ধরেছিলাম, চেষ্টা করেছিলাম তার বলে দেওয়া উত্তরগুলো না শুনতে, তবুও যা যা কানে ঢুকে গেছে সেগুলো আমি আর লিখিইনি। যা লিখেছি আমার নিজের ভেতর থেকে আসা উত্তরই শুধু লিখেছি এবং এর মধ্যে নকলের মিশ্রণ রাখতে চাইনি। সত্যি!
একদিন গার্ডে থাকা একজন ম্যাডাম আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইলেন। লিখছিলাম আমি, তিনি দেখতে থাকলেন। হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি নিজের থেকেই উত্তর লিখছ?’ আমি তখন গর্বভরে বললাম, ‘জি।’ ম্যাডাম দূরে চলে গেলেন। তারপর জোর গলায় ঘোষণা দিলেন, ‘মাত্র একজন ছাত্র, একজনমাত্র পরীক্ষার্থী পেয়েছি এই হলে, সে একাই পরীক্ষা দিচ্ছে। আর বাকি সবাই ফাউ! এই একজন বাদে তোমরা কেউই পরীক্ষা দিচ্ছ না!’
কেন্দ্রের হেড স্যারের কাছে গিয়েও তিনি আমার কথা জানিয়ে প্রশংসা করলেন, তাকে নিয়ে এসে আমাকে দেখালেনও।
এই সময়টাতে গত বছর মাদরাসায় ছিলাম। মাদরাসায় আমার মুহতারাম উস্তাদের কাছে পরীক্ষার ফলাফল জানাতে উতলা হয়ে উঠেছিলাম। তাই মোবাইল করেছি মাগরিবের পর। নিজের ফলাফল জানিয়ে আমার ছাত্রভাইদের কথাও জানালাম তখন। সব শুনে হুজুর বললেন, ‘খুব ভালো কথা।…আর তাদেরকে বলুন, আমাদের মাদরাসায় এসে এক বছর পড়ে যেতে।’ মাদরাসায় পড়ে তাদেরও যাতে এইটুকু মেধা হয়, যাতে দুই বছর পড়েও অন্তত আমার মতো ছয় মাসের পড়ার ফল পাওয়া যায়। ‘…আর যে ম্যাডাম আপনাকে নিয়ে সেই মন্তব্য করেছিলেন, তার সাথে যোগাযোগ হয়েছে কি?’ ম্যাডাম আমাকে বলেছিলেন, ‘যদি নকল না করো, আমি বলে দিলাম, তুমি ফেইল।’ হুজুর বললেন, ‘সবার সাথেই যোগাযোগ করে নিন।’
এরপর বললেন, ‘আপনার সাথি ভাইদের কি জানাব?’ মানে, মাদরাসায় আমার যে সাথিরা এখন অবধি আছে। ‘তাদেরও জানার আগ্রহ। অবশ্য সাথে মিষ্টিটিষ্টিও খেতে চায়।’ ফলাফল না জেনেই তাদের এই মিষ্টি চাওয়া! শুনে আমি হেসে ফেললাম। আর যা সুন্দর করে তিনি কথা বলেন, ভালো লেগে যায়।
বিকালবেলা, আমার একজন স্যারের কাছে গেলাম।[1] ওই সময় একজন ছাত্রীকে পড়াচ্ছিলেন। রুমে ঢোকার পর তিনি আমার দিকে তাকানো মাত্রই বলে উঠলাম, ‘স্যার, ফোর পয়েন্ট জিরো সিক্স।’
যা বোঝার, বুঝে গেলেন, বললেন, ‘বেশ তো ভালোই। মাত্র তিন মাস পড়েই এই করতে পেরেছ, শুকরিয়া!’
কেন আমি এসব লিখছি এখানে। নিজের গুণাবলি প্রকাশ করার জন্য কি। আসলেই। যখন আমার চারপাশে নকলের এমন ছড়াছড়ি, তখন এটা আমার গর্বেরই বিষয়। তবে যদি ফেল করেও বসতাম, তবু হাসতাম, বলতাম যে, আমার জন্য ‘মহাসুযোগ’ ছিল, চাইলেই আরামসে পাশ করেও ভালো নম্বর করতে পারতাম, কিন্তু তা না চেয়ে ফেল করেছি। ওই ফেল করা নম্বরটিও তো নিজের মেধায় পেয়েছি।
গার্ড স্যার ও ম্যাডাম প্রশ্নপত্রের উত্তরের ‘ফটোকপি’ এনে এনে বিলি করে দিয়েছেন, হলের সকল পরীক্ষার্থীর হাতে হাতে দিয়েছেন, অথচ যাদের এসব দিয়েছেন, আজ তারাই ফেল করে বসেছে। তোমার শোকর হে আল্লাহ, আমার অবস্থার জন্য তোমার শোকর।
[1] মতি স্যার। আল্লাহ পাক তার ওপর রহম করুন। তিনি ইনতেকাল করেছেন।