
১৫ জুন ২০১৭
পথচারী, গাড়ির যাত্রী, সবাই তাকিয়ে দেখছে। গাড়ি-সড়কের পাশের বন্ধ দোকানের সামনে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বসে আছি। বসে আছি, বসেই আছি, যা-ই থাকি, জীবনে দেখোনি বাপু! কারও কারও চোখের ভাষায় তো মনে হচ্ছে এখানে যেন আমি অপেক্ষায় আছি কোনো তাইয়েবা মারগুবার।
অপেক্ষার সময় খানিক হলেও দীর্ঘ মনে হয়, সেখানে যদি সঙ্গ দিতে হয় এরকম এক পরিস্থিতির! তবুও সময় বয়ে গেল। কাঁটায় কাঁটায় সময় কেটে গেল। মিনিটের পর মিনিট সময় পার হলো। তারপর হঠাৎ পেছনের দিকে চেয়ে দেখি এদিক থেকে তিনি আসছেন, এসেই পড়েছেন; দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম, ব্যাগ ঠিকঠাক করতে করতে এগিয়ে গিয়ে মুসাফাহা করলাম।
এইচ এম ইন্সটিটিউশন স্কুল এন্ড কলেজ, করটিয়া, টাঙ্গাইল; এখানকার জন্য নির্বাচিত হয়েছি। কলেজ দেখতে এসেছি। নানির ভাইয়ের ছেলে, আতাউল্লাহ মামা এদিকটাতেই থাকেন। তাকে মোবাইল করে এসেছি আমাকে কলেজ ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য।
এখানে এসেছি সিএনজি হয়ে, তারপর বাসে চেপে। বাস আমাকে নামিয়েছে কলেজের গেট থেকে বাস-চাকার বিশ ‘কদম’ দূরে। ভাবছিলাম মামাকে গেটে দাঁড়ানো পাব, নেমে তাকিয়ে দেখি ওখানে নেই।
মামা বললেন, ‘জমিদারবাড়ির ওদিকে থাকি।’ বুঝতে পারলাম, হয়তো বেশ দূর, দেরিটা সেজন্যই হয়েছে।
মামা করটিয়া জমিদারবাড়ির কথা বলতে আমার মনে পড়ল, ওটাকে একটা স্কুল করা হয়েছিল। দু-তিন মাস আগে আহসান হাবীব ইমরোজ স্যারের বই ‘মোরা বড় হতে চাই’ পড়ার পর লেখক সম্পর্কে জানার আগ্রহে গুগল সার্চ দিয়েছিলাম। গুগলেই জেনেছি তিনি দূরের কেউ নন, আমাদের টাঙ্গাইলেরই, এবং এই করটিয়ার। করটিয়া জমিদারবাড়ির একটা দিক পঁচিশ বছরের জন্য তিনিই লিজ নিয়ে ‘লাইটহাউজ’ নামে একটা প্রাইভেট স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বারো বছর পর এক রাতে এলাকার কিছু মন্দ লোক স্কুলের এক যুগের জমা করা অর্ধ কোটিরও বেশি টাকার মূল্যবান সম্পদ, আসবাব পুড়িয়ে দিয়েছিল। দিনে শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসার পর কান্নাকাটি শুরু করেছিল।
মামাকে জিজ্ঞেস করলাম এ ব্যাপারে। বললেন, ‘তোমাকে ওখানেও নিয়ে যাব।’
আমাদের এইচ এম দেখে করটিয়া সা’দত কলেজ দেখতে গেলাম। দুটো কলেজ রাস্তার এপার-ওপার। সা’দত কলেজ এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন একটি কলেজ। প্রাচীন কলেজ। কলেজের ইমারতগুলো শাহি ধাঁচে গড়া। কলেজের উত্তর-পুবে কয়েকটি বড় ছাত্রাবাস আছে। আর ছাত্রীবাস আছে দক্ষিণ-পশ্চিমে।
অন্যান্য কলেজের মতো এখানেও ‘জুটি সম্প্রদায়ের’ ব্যতিক্রম নেই। হাঁটছিলাম মামা ও তার বন্ধুর সঙ্গে। একজন মেয়েলোকের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম। ডানেই ছাত্রাবাস। আমাদের পেছনে আরেক লোক আসছিলেন। ছাত্রাবাস থেকে তাকে ডেকে জানতে চাওয়া হলো, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’ তিনি বললেন, ‘গার্ল ফ্রেন্ড খুঁজতে।’ এই কথাটুকু সেই মেয়েও শুনলেন। আরও বেশ দূরে এগিয়ে যাওয়ার পর অবাক হয়ে দেখলাম, তারা দুজন বটতলায় বসে আছে।
আবার কলেজ অধ্যক্ষের বাসভবনের পাশের আমগাছে চড়েছে দুজন। বৃষ্টি হয়েছিল, তাই গাছ পিচ্ছিল। প্রশস্ত পুরোনো পিচ্ছিল আমগাছে দুজন পুরুষছেলেকে উঠিয়ে রেখেছে নিচের দুতিনজন মেয়ে। একটু এদিক-ওদিক হলেই পা হড়কাবে। মামা বললেন, ‘দেখো ভাই, পড়ে যেয়ো না, আম খাওয়ার শখ জীবনের জন্য মিটে যাবে।’ একজন মেয়ে তখনই বলে উঠলেন, ‘ভাই, পড়ে গেলে আমি কিন্তু কাঁদব!’
মামার বন্ধু ওই মেয়েটির কথা আমাদের কানে ব্যঙ্গ করতে থাকলেন, আমরা এগিয়ে গেলাম।
বিরাট জামগাছ। জামগাছতলায় জাম পড়ে আছে অনেক। গাছে চেয়ে দেখি ডালগুলো ছেয়ে আছে কালোজামে। মামা বললেন, ‘ইশরে! এখন যদি শুধু রমজান মাস না হতো, গাছে চড়ে বসে দিন কাটিয়ে দিতাম।’
ঘুরে ঘুরে এসে পড়েছি মেয়েদের আবাসবিল্ডিংগুলোর সীমানা দেয়ালঘেঁষা রাস্তায়। মামার বন্ধুটি মামার কাছে বলে উঠল, ‘ওকে পাঠিয়ে দিন গেট দিয়ে, ভেতরে ঘুরে আসুক। ও তো ছোট আছে, ভেতরে চার-ছয়টা ইফতারির দাওয়াত পেয়ে যাবে!’ আমি গুরুগম্ভীর হয়ে চলতে থাকলাম। তামাশা নাকি!